Hitta.se – তে Jabin Jahan

১৪-মে-২০২১ঃ ঊপল্যান্ড ভাসবি যাচ্ছি নিওনের বাসায়। মাস্ত্রা হয়ে, কমিঊটার ট্রেনে। বত্রিশ কিলো ডিস্টেন্স, মাঝখানে মোট সতেরোটা ষ্টেশনে ট্রেন থামবে। মোট সাতান্নো মিনিটের মতো লাগবে। ফ্লেমিংসবারী ষ্টেশনে বসে আছি। উইক-ডে তে ট্রেন ঘন্টায় আটটা। গতকাল রেড-ডে বা ন্যাশনাল হলিডে ছিলো, আগামীকাল শুক্রবার তাই আজ – ব্রীজ হলিডে। যে কারনে ট্রেন ঘন্টায় চারটা। আরো মিনিট দশেক বাকী। জাবিন-আরিব বসে বেঞ্চে। এর মাঝেই শরীয়তি বিধান নিয়ে হাল্কা পারিবারিক আলোচনা শুরু হল। আনফরচুনেটলি, প্লাটফর্ম গরম হবার আগেই ট্রেন চলে আসলো।

মাস্ত্রা আসার পর জাবিন খেয়াল করলো – আমাদের প্রানবন্ত উত্তপ্ত আলোচনার বলী হয়েছে – জাবিনের ওয়ালেট, সেটি হারিয়েছে। কি কি হারালো – এক্সট্রা চশমা, দুইটা লিপষ্টিক, বাংলাদেশের বিএসআইএসসি (স্কুল এন্ড কলেজ) এর আইডি কার্ড, আর ট্রেনের এসএল কার্ড। মারাত্বক গুরুত্বপুর্ন তেমন কিছু নাই। জাবিনের মেইন আক্ষেপ, শুধু বিএসআইএসসি এর আইডি কার্ড হারানোতে। সেই কার্ডে বা কোন কিছুতে এখানকার ঠিকানা, মোবাইল নম্বর বা ইমেইল (বা জিমেইল) এড্রেস নাই। তাই, হারানো জিনিস ফিরে পাবার সম্ভবনা আমি দেখছি একেবারে জিরো।

সুইডেনে যে কোন বিপদের প্রাইমারী কন্সালট্যান্ট – আমার এক্স-বাংলাট্রাক জুনিওর বাকীবিল্লাহকে ফোন দিলাম – জানালো এসএল (স্টকহোমের মেইন ট্রান্সপোর্ট কোম্পানী – ট্রেন, বাস, ট্রাম, ফেরী) লষ্ট এন্ড ফাঊন্ড এ গেলে, যদি কেউ জমা তাহলে হারানো জিনিস পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু স্পেসিফিক কোথায় যেতে হবে বাকী বলতে পারলো না। এসএল লষ্ট এন্ড ফাঊন্ড এর ওয়েব সাইটে ঢুকলাম – ফাঊন্ড লিস্টে পেলাম প্রচুর ব্যাকপ্যাক, ছাতা, রেইনকোট, ব্যাংকের কার্ড, আইডি কার্ড, মোবাইল ফোন আর ওয়ালেট। আমাদেরটা পেয়েছে নাকি বোঝার কোন ঊপায় নাই।

১৭-মে-২০২১ঃ আশা না হারিয়ে এসএল হেল্প লাইনে ফোন দিলাম। ওরা জানালো লষ্ট এন্ড ফাঊন্ড এ কথা বলতে হলে আলাদা আইভিআর এ গিয়ে সুইডিসে কথা বলতে হবে। পারবো না। ওয়ালেটপাবার আশা বাদ দিলাম।

২০-মে-২০২১ঃ বিকেলে অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় অভ্যাসবশতঃ লেটার বক্স চেক করতে গিয়ে দেখলাম লষ্ট এন্ড ফাঊন্ড একটা চিঠি দিয়েছে। সন্দেহ করছে যে আমাদের হারানো কোন কিছু একটা তারা পেয়েছে। এড্রেস দিয়েছে, বলছে সেখানে গিয়ে খোজ করতে। সেটা শহরে সেন্ট্রাল ষ্টেশনের পাশে। যেতে আধাঘন্টা লাগবে। আমার আগ্রহ নাই, কিন্তু জাবিনের সেই বিএসআইএসসি এর আইডি কার্ড। কোন উপায় নেই, সেটা আনতে যেতেই হবে। লষ্ট এন্ড ফাঊন্ড শনিবারে যেহেতু খোলা, তাই সপরিবারে রওনা হলাম। সেন্ট্রাল ষ্টেশন মাটির নীচে ছয়তলা। একাবারে নীচের তলার কমিঊটার ট্রেনের ষ্টেশন। সেখান থেকে বিশাল সব এসকেলেটর বেয়ে জিরো লেভেলের ট্রাম ষ্টেশনের পরে এক বিশাল গির্জা। তার পেছেনেই – এসএল লষ্ট এন্ড ফাঊন্ড এর অফিস। জাবিন ভিতরে ঢুকে দুই মিনিটের মাথায় হাতে ওয়ালেট, মুখে হাসি নিয়ে বের হয়ে আসলো।

আমি তড়িঘড়ি করে ব্যাগ খুলে বোঝার চেষ্টা করলাম – আমাদের এড্রেস কিভাবে এর পেল। কোনভাবেই বুঝতে পারলাম না।

পাচ মিনিট হাটার পর – মাথায় অন্য আইডিয়া এলো, ওয়েবে লগিন করলাম। এবার আমার মুখে হাসি ফুটলো। Hitta.se – তে Jabin Jahan একজনই আছে।

ব্যাংকক এয়ারপোর্টে এসে পুলিশের ইন্টারোগেশন

বাংলাদেশ থেকে ব্যাংকক এয়ারপোর্টে নামলাম। সাত ঘন্টার ট্রানজিট। দুপুরে ফ্লাইটে যা দিয়েছিলো তা হজম হয়ে গিয়েছে। আসার সময় বার্গার কিং এ ডাবল ফিস বার্গার খেয়েছিলাম। সুইডেনের আরলান্ডা এয়ারপোর্টের থেকেও দাম বেশী। মেজাজ খারাপ হল যখন তারা বার্গার কিং এর ভিআইপি ডিসকাউন্ট কার্ড চিনলো না। আমার আগের ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের অধিকাংশগুলোর অভিজ্ঞতাগুলো ছিল কোম্পানীর কাজে। যার ফলে খাবারের দাম নিয়ে কখনোই মাথা ঘামাতে হয় নাই। স্পেশ্যালী বাংলাট্রাকের ট্যুরগুলো। যেখানে থাকার থাকো, যা খাবার খাও, যা করার করো – সবই অ্যাপ্রুভড। মালিকপক্ষের খোলা আর এমন উদার মানসিকতার কারনে বাংলা ট্রাকের চাকুরি একটা লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্সও বটে। যারা করেছে একমাত্র তারাই জানে।

সূবর্নভুমি এয়ারপোর্টে খাবারের দোকান নেহায়তই কম না। কিন্তু কেন জানি ক্ষুধা থাকার পরও খাওয়ার ইচ্ছে জাগলো না। আবারো বার্গার কিং এ বসলাম – যাস্ট একটা বড় ফ্রেঞ্চফ্রাই আর পানি নিয়ে। এটা শেষ করে হাঁটাহাঁটি শুরু করলাম এয়ারপোর্ট ঘুরে দেখার জন্য। বেশ বড় এয়ারপোর্ট। ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান থেকে কিছু কেনার চেষ্টা করলাম, দাম হিসেব করে কেনার ইচ্ছে হলো না। শুধু একটা ড্রাইড মিক্সড ফ্রুট প্যাক কিনলাম। এটারো দাম অযথা বেশি মনে হল।

তিন ঘন্টা ঘোরার পর গেট নম্বরের ঘোষনা পেলাম। আমারটা সি-১০, এক প্রান্তের শেষ মাথায়। সেদিকে হাঁটা দিলাম। জাবিনকে কল দিলাম। সে তার ল্যাবে কাজ করছে। জানালো – ছেলেরা স্কুলে, পাকিস্তানি বেবী সিটার মেয়েটি আসবে তারাজকে স্কুল আনা আর আরীবকে বাসায় স্কুল ট্যাক্সি থেকে রিসিভ করার জন্য। বাকি সব ইন ট্রাক এ আছে।

এর পর নাজমুল কল দিলো। যথারীতি আপকামিং টেকনোলজি নিয়ে বিশ বছর আগের মতো আলোচনা করতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কিভাবে কেটে গেল টের পেলাম না।

থাই এয়ারোওয়েজের ক্রুরা চলে এসেছে। ঘন্টা খানেক বাকী প্লেন ছাড়ার। বোর্ডিং শুরু হবে অচিরেই। এর মাঝে দুই এয়ারপোর্ট পুলিশ খুব হন্তদন্ত হয়ে আসলো বোর্ডিং কাউন্টারে। একজন হেড টাইপের ক্রুর সাথে জরুরি আলাপে লিপ্ত হলো। হেড ক্রু তার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়লো। দুইজন পুলিশকে রুমের এক কর্নারে বসিয়ে কোন বিশেষ ব্যক্তিকে খোঁজা শুরু করলো। সে খুঁজছে বোর্ডিং পাস ৩৪এ ধারী যাত্রীকে। ভাবলাম, বড় কোন ক্রিমিনাল হবে হয়তো। পাঁচ মিনিট পর টের পেলাম সেই বিশেষ ব্যক্তিটি আমি। একটু ফ্লাসব্যাকে গেলাম – এয়ারপোর্টে ঢোকার পর বাথরুমে গেছি, সুন্দর করে ফ্লাস করেছি। একটা শুকনো ফলের প্যাকেট কিনেছি সেটার মেমো আছে। বার্গার কিং এ খাওয়ার পর টেবিলও পরিস্কার করেছি। এর বাইরে এক থাই মেয়ের দিকে ফ্রাকশন অফ সেকেন্ডের জন্য তাকিয়েছিলাম বটে, তবে মনে হয় সেটা ক্রাইম হবার মতো কিছুনা।

দুই অফিসারের সামনে বসে আছি। বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে পুলিশের ইন্টারোগেশনে, টেনশন হবার কথা। তবে আমি আমার স্বভাববিরুদ্ধ টেনশন ফ্রি মুডে। আসলে বুঝতেছি না, সমস্যাটা কি।

এক অফিসার আমার পাসপোর্ট চাইলো। দিলাম। সে চার রকমের ইউভি, আল্টাভি স্কানার দিয়ে পাসপোর্ট চেক ব্যাস্ত হল। দেড় মিনিট পর আমিই কিউরিয়াস মুডে জানতে চাইলাম

– কিছু পাইলা? সন্দেহজনক?

সে বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকালো। চেকিং বন্ধ করে শুকনোমুখে পারপোর্ট তার সহযোগীকে দিল। সহযোগী পাসপোর্টের পাতাগুলো চেক করে খুশি হয়ে উঠলো। আমাকে জিজ্ঞস করলো

– তুমি সুইডেন থেকে আসছো?

– হুম।

– তোমার তো ভিসা নাই পাসপোর্টে।

আমি অলমোষ্ট বেকুব হয়ে ওয়ালেট থেক ইউটি কার্ড তার হাতে ধরায়ে দিলাম। সে একপলক দেখেই তার সহযোগীর হাতে হস্তান্তর করলো। সহযোগী আবার তার যন্ত্রগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। প্রায় দুই মিনিট পর আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম

– কিছু পাইলা? সন্দেহজনক?

– সে শক্তমুখে জানতে চাইলো এই কার্ড আসল কি না?

আমি আরো শক্তমুখে জানালাম

– এটা সুইডিস সরকার আমাকে দিয়েছে। ওরা বলতে পারবে। আমার হাতে চেক করার মতো কোন যন্ত্র নাই।

সে কার্ড ফেরত দিয়ে আরেক জনের দিকে তাকালো। সে আবার তার দিকে তাকিয়ে। আমি দুজনের দিকে। থাই এয়ারলাইন্সের ভদ্রলোক আমাদের দিকে। সে বোর্ডিং শুরু করতে পারছে না। শেষমেষ আমিই বললাম

– তোমাদের সমস্যা কি? আমাকে বলো। আমিই হেল্প করার চেষ্টা করি।

কয়েক সেকেন্ড মুখ চাওয়া চাওয়ি করার পর লিডার টাইপের জন বলল

– তুমি চার দিনের জন্য বাংলাদেশে গেলা তাও আবার কোন লাগেজ ছাড়া। এটা সন্দেহজনক।

এবার আমি হিতাহিত জ্ঞান হারালাম। আশেপাশে দেয়াল না থাকায় শুধু কপালটা ঠুকতে পারলাম না। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম

– সাথে লাগেজ নাই এটা সমস্য? তাছাড়া এটা আমার ট্রানজিট এয়ারপোর্ট। আরলান্ডা বা শাহজালাল এটা নিয়ে প্রশ্ন করলো না। তোমাদের মাথা ব্যথা কেন?

সে জানালো থাই এয়ারয়েজের কাছে ব্যপারটা সন্দেহজনক মনে হয়েছে। তারা এটা রেইজ করায় আমরা ইনভেষ্টিগেশনে এসেছি। মেজাজ খারপ হয়ে গেল। মোবাইলে ফেসবুক ক্রোমে ওপেন করে ছবিসহ লাষ্ট ষ্ট্যাটাসের ট্রান্সলেশন পড়তে দিলাম। পড়ার পর একটা গ্রুপ ছবি দেখিয়ে বললো

– এরা কারা?

– আমার বন্ধুরা।

– তারা কি করেন?

– সবাই সরকারী অতি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা।

মনে হলো এবার বুঝছে। শুধুমাত্র ‘সরি’ বলে তারা বিদেয় নিলো। বোর্ডিং শুরু হলো। বিমানে উঠে বসলাম। বিমান ছাড়ার কয়েক মিনিট আগে আবারো থাই এয়ারোয়েজের সেই ভদ্রলোক।

– আমি সরি, আজ অনেক সিট ফাঁকা যাচ্ছে তাই তোমার সিটটা একটু চেঞ্জ করে দিয়েছি। তোমার নুতন সিটটা কি একটু দেখবা?

আমি বললাম দেখার দরকার নাই। চলো যাই। ব্যাগ নিয়ে সামনের দিকে এগোলাম। সিট দিয়েছে। বিজনেস ক্লাসে। উইন্ডো সিট। ডিসপ্লেতে দেখাচ্ছে এগারো ঘন্টা পঞ্চান্ন মিনিটের ফ্লাইট। সিটটা হেলিয়ে দিয়ে গা মেলিয়ে দিলাম। জীবনের প্রথম বিজনেস ক্লাস।

আরামে চোখ বুজে এলো। যখন চোখ মেললাম ডেষ্টিনেশন মাত্র চার হাজার কিলোমিটার বাঁকী। প্রায় সাড়ে সাত ঘন্টা ঘুমিয়েছি। আরো ঘন্টা খানেক পর কেবিন ক্রু নাস্তা দিয়ে গেল। সাথে আপেল অরেঞ্জ জুস দুইটাই দিয়ে গেছে। কে বলে টাকায় সুখ কেনা যায় না? শুধু টাকা কিনতে পয়সা লাগে।

ওহ, বাই দা ওয়ে। আমি নিজেও টাকায় সুখ কেনা যায় না বিশ্বাসী পাবলিকের দলে। এই বিশ্বাসেই বিশাল এক প্রশান্তি আছে। তাছাড়া, সুখ কেনার জন্য এতো খাটবে কে?

শুভ জন্মদিন – চন্দন

অলস মানুষ আমার প্রচন্ডই অপছন্দের। তার পরেও রুয়েটে পড়াকালীন সময়ে কিভাবে যেন দুনিয়ার প্রচন্ড অলসদের মাঝের একজন আমার ফ্রেন্ড লিস্টে আমাদের সার্কেলে ঢুকে পড়লো। সে হলো চন্দন।

নাজমুল ইসলাম বাবু আমার সে সময়ের সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ড। সবকিছু নিয়েই সিরিয়াস টাইপের একটা ছেলে। সে রুয়েটের একদিন বাস বা একটা ক্লাসও মিস করে নি। প্রেম ভালোবাসাতে ক্যারিয়ারে ক্ষতি না হয় সদা সতর্ক থাকতো। কোন জুনিয়র আপু তাকে মিসকল দিয়ে ছাত্রজীবনের মহান মৌনব্রত কখনোই ভাংতে পারে নাই। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পরে অবশ্য আমাদের রুয়েটেরই এক বাচ্চা আপুর মিসকল রিসিভ করে বসে। সেই বাচ্চা আপুটি এখন তার নয় বছর বয়সী বাচ্চার মা। সে আরেক গল্প, পরে বলা যাবে।

নাজমুল আর আমার আলোচনার বিষ্যবস্তু ছিলো টেকনিক্যালী খুবই উচ্চমার্গীয়। যেমন, সি প্লাস প্লাস প্রোগ্রামিং দিয়ে কিভাবে জিও থার্মাল এনার্জি সোলার প্যানেলে ফিড করে ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেট করা যাবে – এই টাইপের। এই বিষয়গুলেত নাজমুলের সাথে আমার প্রচুর ডিবেট হতো এবং খুব কম সময়েই আমরা একমত হতে পারতাম। একটা যায়গাতেই আমি আর সে সবসময়ই একমত ছিলাম – চন্দনের ব্যপারে। একটা মানুষ কি পরিমান অলস আর দায়িত্বছাড়া হতে পারে।

চন্দনের আলসেমী ছিলো সর্বজনবিদিত। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে শনিবার দুপুরে ওঠা তার জন্য কমন ব্যপার ছিলো। সেমিষ্টার ফাইনাল পরিক্ষার দিনে আমরা পানি কম খেতাম যাতে বাথরুমে কম যেতে হয়। পরিক্ষার হলে ঢুকার আগ পর্যন্ত আমরা ‘চোথা’ চিবিয়ে ফেলতে সচেষ্ট থাকলেও চন্দন এ ব্যপারে নির্বিকার। পরিক্ষার দিনে রুয়েটের শাটল বাস ধরতে এসে হাই তুলতে তুলতে বাসায় ব্যাক করা চন্দনের জন্য কমন ব্যপার ছিলো। সিজিপিএ এর লাইফে কোন ইম্প্যাক্ট নাই ব্যাপরটা সে আগেই বুঝে গিয়েছিলো। তাই রুয়েটের কোর্সগুলো নিয়ে কোন মাথাব্যথ্যা ছিলো না। আগ্রহে মূল বিষয়ে ছিল সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, এআই আর রোবোটিক্স।

চন্দনের একটা ব্যপারে আমি নাজমুল জেলাস ছিলাম। যে কোন কিছুর সামারী করার ব্যপারে তার মাথা ছিলো ভয়াবহ ঠান্ডা। আমরা কোন একটা প্রোগ্রামিং এর সমস্যা নিয়ে পনেরো দিন ধরে পুরোটাকে জগা আর খিচুড়ি দিয়ে মাখিয়ে তার কাছে নিয়ে যেতাম। তাকে মিনিট দশেক ধরে বোঝেনো পরে সে এক মিনিটে বোঝায়ে দিতো আমরা আসলে কিছই বুঝি নাই। আর তার পরের দশ মিনিট লাগতো সমস্যা সমাধানের জন্য। মাঝে মাঝে আমাদের আরেক গেম/গেম-ইঞ্জিন ডেভোলপার বন্ধু হাসিনুর রহমান রেজা তপু তার প্যাঁচগুলো ছড়ানোর জন্য পুরো কম্পিউটার নিয়ে আসতো চন্দনের বাসায়।

চন্দনের বাসাটা ছিলো আমার কাছে বিশাল এক খনির মতো। বিভিন্ন রাইটারের হাজার হাজার বইয়ে আর ম্যাগাজিনের ছড়ানো ভান্ডার। যায় যায় দিন, সাপ্তাহিক২০০০, রিডার্স ডাইজেস্ট, চিপ বা থিংডিজিটের মতো সব দামী পত্রিকা। সে নিজে পড়তো, আমরা পরতাম। বইপত্র থেকে বই বা থেকে চিপ বা ডিজিট কিনেছে, সে বাসায় নিয়ে যাবার আগে পড়ার জন্য আমার বাসায় নিয়ে যাবার ঘটনা খুবই কমন ছিলো। চন্দন কোন আপত্তি কখনই করে নাই। আমার ধারনা তার আলসেমীও এটার একটা কারন। আপত্তি করতে যে ইফোর্ট দিতে হবে, সেটা দেবার মতোও ইচ্ছা হয়তো তার করতো না। তবে সে সময়ে একশো কুড়ি টাকার ম্যাগাজিন কেনার জন্য যে কলিজা লাগতো সেটা আমার ছিলো না। টাকাও ছিলো না। নাজমুল-চন্দনের-আমাদের বন্ধুত্বের একটা মজার বিষয় ছিলো – রুয়েট আমরা বাইরে খেতাম প্রচুর। অধিকাংশ সময়েই বিল দিতো নাজমুল, চন্দন মাঝে মাঝে। আমি কখনোই না। যতদুর মনে পড়ে এটা নিয়ে আমার কোন লজ্জা ছিলো না, আর তাদের কোন অহংকার ছিলো বলেও মনে পড়ে না। যেন পুরো ব্যপারটাই স্বাভাবিক কিছু।

যাই হোক, প্রসংগে আসি। আমরা রুয়েট পাশ করে গেলাম। চন্দন আটকে গেল তার লম্বা ব্যকলগ পরীক্ষা নিয়ে। তার ব্যকলগের চিন্তায় আমরা রাতে ঘুমুতে পারতাম না, কিন্তু সে নির্বিকার। এবং এই নির্বিকার ভাবেই একদিন সে ব্যকলগগুলোও পাস করে গেল। চাকরীর বাজারে যখন আমরা তখন সবাই রাতজাগি ভালো একটা চাকুরি পেয়ে সম্ভাব্য শ্বাসুড়ী আম্মার মনোজ্জ্বল করার বাসনায়, তখন সে দিনেও ঘুমায়।

আমরা চাকুরি পেয়ে গেলাম। চন্দন পেল। আমরা সবাই আমাদের চাকুরি নিয়ে যতটা চিন্তিত তার চেয়ে বেশী উদ্বিগ্ন চন্দনকে নিয়ে। তার যে লাইফ ষ্টাইল, চাকরি টেকাবে কিভাবে? তার টেনশন নাই, চাকুরি চাকুরি চালিয়ে গিয়েছে তার ষ্টাইলে। অফিস এডজাস্ট করে নিয়েছে। অনেক বড় দায়িত্ব তার মাথায়। ইদানিং ফোন করলে তাকে এয়ারপোর্টেই পাওয়া যায়। অফিসের কাজে দেশের বাইরে যাচ্ছে বা আসছে।
নাজমুল, চন্দন আর আমি। আমাদের তিনজনের মধ্যে – বিশাল কাঁচের একক ক্লোজড রুম, ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য গাড়ি চন্দনই প্রথম নিশ্চিত করেছে।

নাজমুল আর আমি এখনো সিরিয়াস, এখনো একমত একটা ব্যাপারে – এই চন্দন সিরিয়াস কবে হবে?

দেরিতে শুভ জন্মদিন – চন্দন।

১০-ডিসেম্বর-২০২৩

এই সব দিন রাত্রী-১

মহা যন্ত্রনা। সকাল থেকে আজ দুটোই ঝামেলা শুরু করেছে। এমনিতেই আরীব ইদানিং খুবই কোওপারেটিভ হয়েছে। আজ ব্যতিক্রম, প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জী পরে বসে আছে। জামা পরবে না। তারাজের ডায়াপার চেঞ্জ করতে গিয়ে ডায়াপার খুলতে পেরেছি, পরবে না। হাত দিয়ে তার দামী “জিনিস” ধরে বসে আছে। টায়ার্ড হয়ে গেছি। বোধহয় ডায়াবেটিস বেড়েছে। যেই বয়সে নাতী-নাতনীদের বন্ধু বান্ধবীদের সাথে ফ্লার্ট করার কথা কথা, সেই বয়সে ছেলের ডায়াপার বদলাচ্ছি। আজ হুমায়ুন আহমেদ বেঁচে থাকলে ধিক্কার দিতেন আমাকে, নিজেকেও। অনেক চেষ্টার পর দুজনকেই কনভিন্স করতে পারলাম।আরীবকে প্রমিজ করলাম স্কুল শেষে আমি তাকে গাড়ি দিয়ে পিক করবো। তারাজ অজ্ঞাতে কারনে কোন কমিটমেন্ট ছাড়াই ডায়াপার পরেছে, তবে হাত ডায়াপারের ভিতরে। ধরে আছে, এখনো। মেজাজ চরম লেভেলে। সব রাগ গিয়ে পড়লো জাবিনের চাকুরীর ওপর। এই চাকুরির আগে লাইফটা কি মজারই না ছিলো। প্রতি সকালে ট্রেনে চাপতাম তারপর “আইকা”-খোরের মতো টানা সাইত্রিশ মিনিট ঝিমানো। আহ, কি লাইফ ছিলো। তার মাঝখানে কিভাবে জানি এই চাকুরি হয়ে গেল, আর আমার সুখের দফারফা। তার চাকুরি ক্যারোলিনস্কাতে। এটা ইউরোপের টপ তিনটা মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির একটা, সেটার ক্যান্সার রিসার্চ ল্যাবে চাকুরি। হেলাফেলা করা যায় না, ফেলাও যায় না।

যুদ্ধ শেষে বিজয়ী বেশে বিধ্বস্ত হয়ে বাসা থেকে বের হলাম। দুজনকে স্কুলে দিয়ে অফিসে যাব। পার্কিং স্পেসে নেমেই স্বর্নকেশী নীলনয়নার দাঁত বের করা হাই পেয়ে মনের ক্লান্তি পুরাই চলে গেল। বাচ্চা দেখে সে তার গাড়ি থামিয়ে বসে আছে। গাড়িটা সুন্দর, কমিঊনের ঘাস কাটার গাড়ি। সে আমাদের এলাকার লনের ঘাস কাটছে। আবারো দীর্ঘস্বাস ফেললাম, ভুল দেশে জন্মাইছে। আমাদের দেশে জন্মাইলে আজ বুগাতি-মার্সিডিস চালাতো। কম করে হলেও আমেরিকা গিয়ে সাকিব খানের তিন বা চার নম্বর বাচ্চার মা হইতে পারতো। যাকগে কপাল খারাপ।

ঝামেলা ছাড়াই দুজনকে গাড়িতে পুরতে পারলাম। আরীবকে স্কুলে দিয়ে তারাজের স্কুলের কাছাকাছি যেতেই খেয়াল করলাম গাড়ীর সাউন্ড সিস্টেম থেকে হালকা “ঝুমে জো পাঠান” বাজছে। এই গান আমি শুনি না। ওহ না, আসছে বাইরে থেকে লাউড স্পিকারে। আজ রোদ উঠেছে। প্রি-স্কুলের সব বাচ্চাদের এক্টিভিটি সকাল থেকেই বাইরের প্লেগ্রাঊন্ডে। আরবি, ফার্সি, আফ্রো, এ্যাংলো, ইন্দো-পাকিস্থানী বাচ্চার একটা দল শাহরুখ খানের গানের সাথে ফুটস্টেপ মিলাচ্ছে। তারাজ গাড়ি থেকে নেমে তাদের সাথে পা মিলিয়ে দিল।

জাবিন এখানে নাই। থাকলে কেঁদে দিত নির্ঘাত। সুইডেনের স্কুলে হিন্দি গান? আর তার ছেলে তার সাথে পা মেলাচ্ছে।

অর্স্তাবারী ষ্টেশনে চলে এসেছি। নামতে হবে।