
বাংলাদেশ থেকে ব্যাংকক এয়ারপোর্টে নামলাম। সাত ঘন্টার ট্রানজিট। দুপুরে ফ্লাইটে যা দিয়েছিলো তা হজম হয়ে গিয়েছে। আসার সময় বার্গার কিং এ ডাবল ফিস বার্গার খেয়েছিলাম। সুইডেনের আরলান্ডা এয়ারপোর্টের থেকেও দাম বেশী। মেজাজ খারাপ হল যখন তারা বার্গার কিং এর ভিআইপি ডিসকাউন্ট কার্ড চিনলো না। আমার আগের ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের অধিকাংশগুলোর অভিজ্ঞতাগুলো ছিল কোম্পানীর কাজে। যার ফলে খাবারের দাম নিয়ে কখনোই মাথা ঘামাতে হয় নাই। স্পেশ্যালী বাংলাট্রাকের ট্যুরগুলো। যেখানে থাকার থাকো, যা খাবার খাও, যা করার করো – সবই অ্যাপ্রুভড। মালিকপক্ষের খোলা আর এমন উদার মানসিকতার কারনে বাংলা ট্রাকের চাকুরি একটা লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্সও বটে। যারা করেছে একমাত্র তারাই জানে।
সূবর্নভুমি এয়ারপোর্টে খাবারের দোকান নেহায়তই কম না। কিন্তু কেন জানি ক্ষুধা থাকার পরও খাওয়ার ইচ্ছে জাগলো না। আবারো বার্গার কিং এ বসলাম – যাস্ট একটা বড় ফ্রেঞ্চফ্রাই আর পানি নিয়ে। এটা শেষ করে হাঁটাহাঁটি শুরু করলাম এয়ারপোর্ট ঘুরে দেখার জন্য। বেশ বড় এয়ারপোর্ট। ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান থেকে কিছু কেনার চেষ্টা করলাম, দাম হিসেব করে কেনার ইচ্ছে হলো না। শুধু একটা ড্রাইড মিক্সড ফ্রুট প্যাক কিনলাম। এটারো দাম অযথা বেশি মনে হল।
তিন ঘন্টা ঘোরার পর গেট নম্বরের ঘোষনা পেলাম। আমারটা সি-১০, এক প্রান্তের শেষ মাথায়। সেদিকে হাঁটা দিলাম। জাবিনকে কল দিলাম। সে তার ল্যাবে কাজ করছে। জানালো – ছেলেরা স্কুলে, পাকিস্তানি বেবী সিটার মেয়েটি আসবে তারাজকে স্কুল আনা আর আরীবকে বাসায় স্কুল ট্যাক্সি থেকে রিসিভ করার জন্য। বাকি সব ইন ট্রাক এ আছে।
এর পর নাজমুল কল দিলো। যথারীতি আপকামিং টেকনোলজি নিয়ে বিশ বছর আগের মতো আলোচনা করতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কিভাবে কেটে গেল টের পেলাম না।
থাই এয়ারোওয়েজের ক্রুরা চলে এসেছে। ঘন্টা খানেক বাকী প্লেন ছাড়ার। বোর্ডিং শুরু হবে অচিরেই। এর মাঝে দুই এয়ারপোর্ট পুলিশ খুব হন্তদন্ত হয়ে আসলো বোর্ডিং কাউন্টারে। একজন হেড টাইপের ক্রুর সাথে জরুরি আলাপে লিপ্ত হলো। হেড ক্রু তার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়লো। দুইজন পুলিশকে রুমের এক কর্নারে বসিয়ে কোন বিশেষ ব্যক্তিকে খোঁজা শুরু করলো। সে খুঁজছে বোর্ডিং পাস ৩৪এ ধারী যাত্রীকে। ভাবলাম, বড় কোন ক্রিমিনাল হবে হয়তো। পাঁচ মিনিট পর টের পেলাম সেই বিশেষ ব্যক্তিটি আমি। একটু ফ্লাসব্যাকে গেলাম – এয়ারপোর্টে ঢোকার পর বাথরুমে গেছি, সুন্দর করে ফ্লাস করেছি। একটা শুকনো ফলের প্যাকেট কিনেছি সেটার মেমো আছে। বার্গার কিং এ খাওয়ার পর টেবিলও পরিস্কার করেছি। এর বাইরে এক থাই মেয়ের দিকে ফ্রাকশন অফ সেকেন্ডের জন্য তাকিয়েছিলাম বটে, তবে মনে হয় সেটা ক্রাইম হবার মতো কিছুনা।
দুই অফিসারের সামনে বসে আছি। বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে পুলিশের ইন্টারোগেশনে, টেনশন হবার কথা। তবে আমি আমার স্বভাববিরুদ্ধ টেনশন ফ্রি মুডে। আসলে বুঝতেছি না, সমস্যাটা কি।
এক অফিসার আমার পাসপোর্ট চাইলো। দিলাম। সে চার রকমের ইউভি, আল্টাভি স্কানার দিয়ে পাসপোর্ট চেক ব্যাস্ত হল। দেড় মিনিট পর আমিই কিউরিয়াস মুডে জানতে চাইলাম
– কিছু পাইলা? সন্দেহজনক?
সে বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকালো। চেকিং বন্ধ করে শুকনোমুখে পারপোর্ট তার সহযোগীকে দিল। সহযোগী পাসপোর্টের পাতাগুলো চেক করে খুশি হয়ে উঠলো। আমাকে জিজ্ঞস করলো
– তুমি সুইডেন থেকে আসছো?
– হুম।
– তোমার তো ভিসা নাই পাসপোর্টে।
আমি অলমোষ্ট বেকুব হয়ে ওয়ালেট থেক ইউটি কার্ড তার হাতে ধরায়ে দিলাম। সে একপলক দেখেই তার সহযোগীর হাতে হস্তান্তর করলো। সহযোগী আবার তার যন্ত্রগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। প্রায় দুই মিনিট পর আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম
– কিছু পাইলা? সন্দেহজনক?
– সে শক্তমুখে জানতে চাইলো এই কার্ড আসল কি না?
আমি আরো শক্তমুখে জানালাম
– এটা সুইডিস সরকার আমাকে দিয়েছে। ওরা বলতে পারবে। আমার হাতে চেক করার মতো কোন যন্ত্র নাই।
সে কার্ড ফেরত দিয়ে আরেক জনের দিকে তাকালো। সে আবার তার দিকে তাকিয়ে। আমি দুজনের দিকে। থাই এয়ারলাইন্সের ভদ্রলোক আমাদের দিকে। সে বোর্ডিং শুরু করতে পারছে না। শেষমেষ আমিই বললাম
– তোমাদের সমস্যা কি? আমাকে বলো। আমিই হেল্প করার চেষ্টা করি।
কয়েক সেকেন্ড মুখ চাওয়া চাওয়ি করার পর লিডার টাইপের জন বলল
– তুমি চার দিনের জন্য বাংলাদেশে গেলা তাও আবার কোন লাগেজ ছাড়া। এটা সন্দেহজনক।
এবার আমি হিতাহিত জ্ঞান হারালাম। আশেপাশে দেয়াল না থাকায় শুধু কপালটা ঠুকতে পারলাম না। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম
– সাথে লাগেজ নাই এটা সমস্য? তাছাড়া এটা আমার ট্রানজিট এয়ারপোর্ট। আরলান্ডা বা শাহজালাল এটা নিয়ে প্রশ্ন করলো না। তোমাদের মাথা ব্যথা কেন?
সে জানালো থাই এয়ারয়েজের কাছে ব্যপারটা সন্দেহজনক মনে হয়েছে। তারা এটা রেইজ করায় আমরা ইনভেষ্টিগেশনে এসেছি। মেজাজ খারপ হয়ে গেল। মোবাইলে ফেসবুক ক্রোমে ওপেন করে ছবিসহ লাষ্ট ষ্ট্যাটাসের ট্রান্সলেশন পড়তে দিলাম। পড়ার পর একটা গ্রুপ ছবি দেখিয়ে বললো
– এরা কারা?
– আমার বন্ধুরা।
– তারা কি করেন?
– সবাই সরকারী অতি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা।
মনে হলো এবার বুঝছে। শুধুমাত্র ‘সরি’ বলে তারা বিদেয় নিলো। বোর্ডিং শুরু হলো। বিমানে উঠে বসলাম। বিমান ছাড়ার কয়েক মিনিট আগে আবারো থাই এয়ারোয়েজের সেই ভদ্রলোক।
– আমি সরি, আজ অনেক সিট ফাঁকা যাচ্ছে তাই তোমার সিটটা একটু চেঞ্জ করে দিয়েছি। তোমার নুতন সিটটা কি একটু দেখবা?
আমি বললাম দেখার দরকার নাই। চলো যাই। ব্যাগ নিয়ে সামনের দিকে এগোলাম। সিট দিয়েছে। বিজনেস ক্লাসে। উইন্ডো সিট। ডিসপ্লেতে দেখাচ্ছে এগারো ঘন্টা পঞ্চান্ন মিনিটের ফ্লাইট। সিটটা হেলিয়ে দিয়ে গা মেলিয়ে দিলাম। জীবনের প্রথম বিজনেস ক্লাস।
আরামে চোখ বুজে এলো। যখন চোখ মেললাম ডেষ্টিনেশন মাত্র চার হাজার কিলোমিটার বাঁকী। প্রায় সাড়ে সাত ঘন্টা ঘুমিয়েছি। আরো ঘন্টা খানেক পর কেবিন ক্রু নাস্তা দিয়ে গেল। সাথে আপেল অরেঞ্জ জুস দুইটাই দিয়ে গেছে। কে বলে টাকায় সুখ কেনা যায় না? শুধু টাকা কিনতে পয়সা লাগে।
ওহ, বাই দা ওয়ে। আমি নিজেও টাকায় সুখ কেনা যায় না বিশ্বাসী পাবলিকের দলে। এই বিশ্বাসেই বিশাল এক প্রশান্তি আছে। তাছাড়া, সুখ কেনার জন্য এতো খাটবে কে?