অলস মানুষ আমার প্রচন্ডই অপছন্দের। তার পরেও রুয়েটে পড়াকালীন সময়ে কিভাবে যেন দুনিয়ার প্রচন্ড অলসদের মাঝের একজন আমার ফ্রেন্ড লিস্টে আমাদের সার্কেলে ঢুকে পড়লো। সে হলো চন্দন।
নাজমুল ইসলাম বাবু আমার সে সময়ের সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ড। সবকিছু নিয়েই সিরিয়াস টাইপের একটা ছেলে। সে রুয়েটের একদিন বাস বা একটা ক্লাসও মিস করে নি। প্রেম ভালোবাসাতে ক্যারিয়ারে ক্ষতি না হয় সদা সতর্ক থাকতো। কোন জুনিয়র আপু তাকে মিসকল দিয়ে ছাত্রজীবনের মহান মৌনব্রত কখনোই ভাংতে পারে নাই। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পরে অবশ্য আমাদের রুয়েটেরই এক বাচ্চা আপুর মিসকল রিসিভ করে বসে। সেই বাচ্চা আপুটি এখন তার নয় বছর বয়সী বাচ্চার মা। সে আরেক গল্প, পরে বলা যাবে।
নাজমুল আর আমার আলোচনার বিষ্যবস্তু ছিলো টেকনিক্যালী খুবই উচ্চমার্গীয়। যেমন, সি প্লাস প্লাস প্রোগ্রামিং দিয়ে কিভাবে জিও থার্মাল এনার্জি সোলার প্যানেলে ফিড করে ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেট করা যাবে – এই টাইপের। এই বিষয়গুলেত নাজমুলের সাথে আমার প্রচুর ডিবেট হতো এবং খুব কম সময়েই আমরা একমত হতে পারতাম। একটা যায়গাতেই আমি আর সে সবসময়ই একমত ছিলাম – চন্দনের ব্যপারে। একটা মানুষ কি পরিমান অলস আর দায়িত্বছাড়া হতে পারে।
চন্দনের আলসেমী ছিলো সর্বজনবিদিত। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে শনিবার দুপুরে ওঠা তার জন্য কমন ব্যপার ছিলো। সেমিষ্টার ফাইনাল পরিক্ষার দিনে আমরা পানি কম খেতাম যাতে বাথরুমে কম যেতে হয়। পরিক্ষার হলে ঢুকার আগ পর্যন্ত আমরা ‘চোথা’ চিবিয়ে ফেলতে সচেষ্ট থাকলেও চন্দন এ ব্যপারে নির্বিকার। পরিক্ষার দিনে রুয়েটের শাটল বাস ধরতে এসে হাই তুলতে তুলতে বাসায় ব্যাক করা চন্দনের জন্য কমন ব্যপার ছিলো। সিজিপিএ এর লাইফে কোন ইম্প্যাক্ট নাই ব্যাপরটা সে আগেই বুঝে গিয়েছিলো। তাই রুয়েটের কোর্সগুলো নিয়ে কোন মাথাব্যথ্যা ছিলো না। আগ্রহে মূল বিষয়ে ছিল সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, এআই আর রোবোটিক্স।
চন্দনের একটা ব্যপারে আমি নাজমুল জেলাস ছিলাম। যে কোন কিছুর সামারী করার ব্যপারে তার মাথা ছিলো ভয়াবহ ঠান্ডা। আমরা কোন একটা প্রোগ্রামিং এর সমস্যা নিয়ে পনেরো দিন ধরে পুরোটাকে জগা আর খিচুড়ি দিয়ে মাখিয়ে তার কাছে নিয়ে যেতাম। তাকে মিনিট দশেক ধরে বোঝেনো পরে সে এক মিনিটে বোঝায়ে দিতো আমরা আসলে কিছই বুঝি নাই। আর তার পরের দশ মিনিট লাগতো সমস্যা সমাধানের জন্য। মাঝে মাঝে আমাদের আরেক গেম/গেম-ইঞ্জিন ডেভোলপার বন্ধু হাসিনুর রহমান রেজা তপু তার প্যাঁচগুলো ছড়ানোর জন্য পুরো কম্পিউটার নিয়ে আসতো চন্দনের বাসায়।
চন্দনের বাসাটা ছিলো আমার কাছে বিশাল এক খনির মতো। বিভিন্ন রাইটারের হাজার হাজার বইয়ে আর ম্যাগাজিনের ছড়ানো ভান্ডার। যায় যায় দিন, সাপ্তাহিক২০০০, রিডার্স ডাইজেস্ট, চিপ বা থিংডিজিটের মতো সব দামী পত্রিকা। সে নিজে পড়তো, আমরা পরতাম। বইপত্র থেকে বই বা থেকে চিপ বা ডিজিট কিনেছে, সে বাসায় নিয়ে যাবার আগে পড়ার জন্য আমার বাসায় নিয়ে যাবার ঘটনা খুবই কমন ছিলো। চন্দন কোন আপত্তি কখনই করে নাই। আমার ধারনা তার আলসেমীও এটার একটা কারন। আপত্তি করতে যে ইফোর্ট দিতে হবে, সেটা দেবার মতোও ইচ্ছা হয়তো তার করতো না। তবে সে সময়ে একশো কুড়ি টাকার ম্যাগাজিন কেনার জন্য যে কলিজা লাগতো সেটা আমার ছিলো না। টাকাও ছিলো না। নাজমুল-চন্দনের-আমাদের বন্ধুত্বের একটা মজার বিষয় ছিলো – রুয়েট আমরা বাইরে খেতাম প্রচুর। অধিকাংশ সময়েই বিল দিতো নাজমুল, চন্দন মাঝে মাঝে। আমি কখনোই না। যতদুর মনে পড়ে এটা নিয়ে আমার কোন লজ্জা ছিলো না, আর তাদের কোন অহংকার ছিলো বলেও মনে পড়ে না। যেন পুরো ব্যপারটাই স্বাভাবিক কিছু।
যাই হোক, প্রসংগে আসি। আমরা রুয়েট পাশ করে গেলাম। চন্দন আটকে গেল তার লম্বা ব্যকলগ পরীক্ষা নিয়ে। তার ব্যকলগের চিন্তায় আমরা রাতে ঘুমুতে পারতাম না, কিন্তু সে নির্বিকার। এবং এই নির্বিকার ভাবেই একদিন সে ব্যকলগগুলোও পাস করে গেল। চাকরীর বাজারে যখন আমরা তখন সবাই রাতজাগি ভালো একটা চাকুরি পেয়ে সম্ভাব্য শ্বাসুড়ী আম্মার মনোজ্জ্বল করার বাসনায়, তখন সে দিনেও ঘুমায়।
আমরা চাকুরি পেয়ে গেলাম। চন্দন পেল। আমরা সবাই আমাদের চাকুরি নিয়ে যতটা চিন্তিত তার চেয়ে বেশী উদ্বিগ্ন চন্দনকে নিয়ে। তার যে লাইফ ষ্টাইল, চাকরি টেকাবে কিভাবে? তার টেনশন নাই, চাকুরি চাকুরি চালিয়ে গিয়েছে তার ষ্টাইলে। অফিস এডজাস্ট করে নিয়েছে। অনেক বড় দায়িত্ব তার মাথায়। ইদানিং ফোন করলে তাকে এয়ারপোর্টেই পাওয়া যায়। অফিসের কাজে দেশের বাইরে যাচ্ছে বা আসছে।
নাজমুল, চন্দন আর আমি। আমাদের তিনজনের মধ্যে – বিশাল কাঁচের একক ক্লোজড রুম, ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য গাড়ি চন্দনই প্রথম নিশ্চিত করেছে।
নাজমুল আর আমি এখনো সিরিয়াস, এখনো একমত একটা ব্যাপারে – এই চন্দন সিরিয়াস কবে হবে?
দেরিতে শুভ জন্মদিন – চন্দন।
১০-ডিসেম্বর-২০২৩